Sunday, June 1, 2014

গোধুলীর ক্ষণিক আলো। (কাল্পনিক)


আজকে হটাৎ নবম-দশম শ্রেণীর রসায়ন বইটা খুলতে গিয়ে একটা কাগজ চোখে পড়ল। মনে করলাম হয়ত কোনো নোট হবে আর কি। কিন্তু তাতে যে, অতীতের যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্ত মনে করিয়ে দিবে তা জানা ছিল না। হইলে হইত কাগজ টা আর খোলা হত না। কাগজ না, ওইটা একটা চিঠি ছিল। না, কোনো প্রেম পত্র নয়।
আমার বন্ধু তপুর চিঠি ছিল। চিঠির লেখা গুলো পড়ে আবারো চোখে দুই এক ফোঁটা অশ্রু চলে আসল। আসবেই না বা কেন? আমার সব কিছুতেই ছিল আমার এই বন্ধু। আমি আজকে বাংলাদেশের সেরা কলেজগুলোর একটার মধ্যে পড়ি। আমার এই অবস্থানে আসার একমাত্র পথপ্রদর্শক ছিল আমার সেই বন্ধু তপু। কিন্তু সময়, পরিবেশ, আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শেষ করে দিয়ে অজানা এক দেশে পার করিয়ে দিলো তপুকে।

২০১১ সাল।
স্কুলে খুব ভালো মানের স্টুডেন্ট ছিলাম না। কোনোমতে পাশ করা যাকে বলে আর কি। বাবা-মা আমাকে নিয়ে ছিলো অনেক উদ্বিগ্ন। উনারা বলেই বসেছিলেন যে, “এস এস সি তে পাশ করবি তো??”
হ্যা। তখন দশম শ্রেনীতে ছিলাম।
১ম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ছিল সেদিন। কোনো রকম ৫০% মার্কস পেয়ে পাশ করলাম। অংকে ৩ নম্বরের জন্য বেচে গিয়েছিলাম। নাইলে ফেল। তপুকে খুজতে লাগলাম।
বরাবরের মতই এবার ৮০+ পেয়ে পাশ করল, তপু। আমি কিছু বুঝিনা। কেমন করে যে ৮০ পায়। আমার জন্যে যা ছিলো, হাতে সাপের মনি পাওয়ার মত। শুধু কল্পনাতেই থাকত।
সমস্যা সেটা না। বাসায় গেলে যে, তুলা ধুনা হবে তা অনেক আগেই বুঝছিলাম। প্রতিদিন স্কুল আর কোচিং শেষ করে আমার বাসার সামনে দাড়াতাম। আজকেও দাড়ালাম।
আমি ভাবলাম যে, বাসায়ই যাবো না। বাসায় গিয়ে কথা শুনার চেয়ে বাইরে বসি বসি মশার কামড় খাওয়া অনেক ভালো।
কিন্তু তপু সেটা মানতে নারাজ। তার কথা হল, আমাকে বাসায় যাইতেই হবে আর আম্মু-আব্বুকে সরিও বলতে হবে। কিন্তু আমার খুব ভয় করছিলো। তপু আমাকে বলল যে, আম্মু-আব্বুকে সে বুঝিয়ে বলবে। আম্মু আব্বু তপুকে আমার থেকেও বেশী আদর করে। কারণ হল, সে আমার চেয়ে অনেক ভালো স্টুডেন্ট।ক্লাসের প্রথম সারির স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন।যাই হোক,সামান্য আশা পাওয়ায় আমি বাসায় গেলাম। থাক সেদিনের কাহিনীটা আর না হয় নাইই বলি। 

সেদিনের পর থেকে আমরা দুজন একসাথে পড়তাম। আম্মু রিকুয়েস্ট করেছিলো তপুকে যেন আমাকে একটু সাথে নিয়ে পড়ে। আমি কোনো কিছু না বুঝলে তপুর থেকে বুঝায় নিতাম। এভাবে দেখতে দেখতেই ঘনিয়ে চলে গেল প্রি-টেস্ট আর টেস্ট পরীক্ষা। আল্লাহর রহমতে আমি ভালো করলাম। নিজের প্রতি একটা আত্মবিশ্বাস এর জন্ম নিল। কিন্তু তপু আমার চেয়ে অনেক বেশী ভালো করত। আমি চেষ্টা করে যেতে লাগলাম।
অতঃপর সেই চূড়ান্ত মূহুর্ত এসে গিয়েছিল। এস.এস.সি. পরীক্ষা। আমার সব গুলো পরীক্ষায় ভালো হল।পরীক্ষার শেষে আমি আর তপু ঝালমূড়ি খেতে খেতে বাসায় ফিরতাম। সবগুলো পরীক্ষায় ভালো হল আমাদের।
৩ মাস বন্ধে ঘুরাফিরা করতে করতে যে রেজাল্ট এর দিনটা কখন এসে পড়ল আমরা খেয়াল এই করলাম না।

হঠাৎ করেই আমাদের মধ্যে রেজাল্ট এর চিন্তা ডুকে গেল। কিন্তু তপুর মধ্যে তেমন চিন্তা কাজ করছিল না মনে হয়। কারণ আমি যত বারই রেজাল্ট এর কথা বলেছি সে তেমন পাত্তা দেয় নি সে কথাটার।
পরের দিন স্কুলে রেজাল্ট দেখার জন্যে গেলাম। আমার A+ আসল। তপুর রেজাল্ট দেখে আমি যেন আকাশ থেকে ভেঙে পড়লাম। এ আমি সত্যি দেখছি তো? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
যে ছেলে স্কুলার টার্ম পরীক্ষায় ৮০+ পেত, যে ছেলে বোর্ডে স্ট্যান্ড করবে বলে স্যারেরা আশা করেছিল সে কিনা পেয়েছে ৩.৬৯???

এরপর আমি তপুকে খুজতে লাগলাম। তার বাসায় গিয়ে দেখলাম সে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার বাবা-মা এই অবস্থা দেখে কান্না-কাটি শুরু করল। তার মা আমাকে জড়ায় ধরি আমাকে অনুরোধ করল আমি যেনো তাকে বুঝায় যে সে যেন ভেঙে না পড়ে। আমার সাড়া পেয়ে তপু দরজা খুলল।
আমার অনেক বুঝানোর পর স্বাভাবিক হল।
স্বাভাবিক ছিল না কিছুই। তার আত্মিয়-স্বজন তাকে অনেক রকমভাবে দোষারোপ করতে লাগল। অনেকে বলল যে, সে নষ্ট হয়ে গেছে। আরো অনেক কিছু।
তপু হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গেল। আমার সাথে ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলত না। তার বাবা-মায়ের সাথেও খুব কম। আমার সাথেও আগের মত কথা বলত না।
কলেজের এডমিশনের দিনটি ছিল আরো ভয়াবহ। সে যে কলেজগুলোতেই apply করেছিল কোনোটাতেই আসে নায়। শেষ পর্যন্ত একটা আধা সরকারী জীর্ণ শীর্ন কলেজ বলা চলে, এমন কলেজে তার স্থান হল। সে ভালোই ছিলই।
কিন্তু……
স্যারের বাসায় স্যারেরা তার কথার কোনো পাত্তাই দিত না। ছেলে-মেয়েরা তাকে হেয় চোখে দেখত।
তপুর যুক্তি-তর্কের অভ্যাস ছিল। একদিন হঠাৎ এক স্যারের বাসায় স্যারের সাথে যুক্তি তর্কে বেধে গেল। স্যার তাকে সামলাতে না পেরে তাকে ছোট লোক এবং আরো অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিল। সেদিনের পরের থেকে সব ছেলে মেয়েরাই তাকে সেসব নামেই ডাকত। একদিন সে কোচিং এ আসায় বন্ধ করে দেয়।
তারপর হঠাৎ একদিন………………………
আমি কলেজে ছিলাম।কল আসল।
তপু আত্মহত্যা করেছে। আমি বিস্বাস করিনি। কারণ বিশ্বাস ছিল যে, এসব করবে। কিন্তু আমার সব বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে সে চলে গেল অজানাপথে। আমার জন্যে রেখে গেল কিছু স্মৃতি আর এই চিঠিটি।

যাতে লিখা ছিল, “ জানতাম না আমার এই পরিণতি হবে। দেখনা তুই কি ছিলি আর এখন কি আর আমি কি ছিলাম আর এখন কি। আসলে জীবনটা বড়ই হাস্যকর। আমি আধাসরকারী কলেজে পড়ি বলে স্যার, পরিবার, সমাজ, বন্ধুমহল আজকে আমাকে এতো হেয় করে। কি দোষ আমার? আমরা কি মানুষ না? আমরা কি ছাত্র না? হ্যা, এইটা হইতে পারে তোদের চেয়ে মেধা অনেক কম। কিন্তু তাই বলে এমন ???? জানিনা কেন সব এমন উলটপালট হয়ে গেল। জানি তুই হইত আমার উপর রেগে আছস। কারণ তোর বিশ্বাস ভাঙছি। কি করতাম বল? আর পারতেছিলাম না। পারলে ক্ষমা করে দিস।
ইতি
তোর কেউ একজন
তপু

এই চিঠি হাতে পাওয়ার পর ভাবলাম, আমাদের সমাজ কত সহজেই না আমাদের এমন সব ছেলেমেয়েদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। সম্পুর্ণ আবর্জনায় ভরতি। জ্ঞানীর কোনো দাম নাই। আসুন আমরা এ আবর্জনা পরিস্কার করি। নাহলে যে, প্রতি বছর এমন হাজারো তপুকে আমাদের হারাতে হবে। এ ব্যাপারে অবিভাবকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

লেখকঃ Habib

No comments:

Post a Comment

পোস্ট সম্পর্কে মতামত দিন