বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে না পারার দীর্ঘশ্বাস ভারী হচ্ছিল আর্জেন্টিনার। অবশেষে ১৯৭৮ সালে দেশের মাটিতেই ঘুচল সেই আক্ষেপ৷ নেপথ্যে জাদুকরি ভূমিকা রাখলেন সিজার লুইস মেনোত্তি৷ আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ জেতানো ফুটবল-মস্তিষ্কের সেই কোচ আজ থেকে কলাম লিখছেন প্রথম আলোয়
দুয়ারে আরেকটি বিশ্বকাপ। তবে এবার আগ্রহটা শুধু ফুটবলেই সীমাবদ্ধ নেই। সত্যি বলছি, বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলে যেসব বিক্ষোভ হচ্ছে, দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন হচ্ছে, এসব নিয়ে আমি শঙ্কিত।
শঙ্কা আছে আরেকটি—ব্রাজিল যদি আগে-ভাগেই বাদ পড়ে যায়! আশা করছি, এমনটা হবে না। তবে ব্রাজিলকে ছাড়া ব্রাজিলে বিশ্বকাপ—কী যে হবে কল্পনাও করতে পারছি না।
আমি অর্থনীতিবিদ নই, তবে আমার মনে হয়েছে, এত বেশি খরচ না করে এবং এতগুলো নতুন স্টেডিয়াম না বানিয়েও ব্রাজিল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারত। ফিফার চাহিদাকে আমি বাস্তবতাবিবর্জিত মনে করি। আমাদের উচিত বাস্তববাদী হওয়া, ঠিক ১৯৬২-এর চিলি বিশ্বকাপের মতো। আমাদের যা আছে, তাই নিয়েই তো কাজ করা উচিত।
এখন ফুটবলে ফিরি। বিশ্বকাপের দাবিদার পুরোনো মুখগুলোই—জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। এখন পর্যন্ত অন্য কেউ এ চক্র ভাঙতে পারেনি। তবে নানা কারণে এবার দক্ষিণ আমেরিকান দলগুলো দিকে পাল্লা ভারী। আবহাওয়া, ভেন্যু এসবই প্রভাব ফেলবে। প্রতিযোগিতা যত এগোবে, প্রভাবটা ততই প্রকট হবে। দেখার বিষয়, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্পেন চাপ সামলাতে পারে কি না। জাভি ও ইনিয়েস্তা চার বছর আগের ফর্মে নেই, তবে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য দল হিসেবে স্পেন খুবই ভালো, তাদের খেলোয়াড়েরাও অসাধারণ।
ব্রাজিলিয়ানরা সব সময়ই লড়াকু, বিশ্বকাপের চিরন্তন দাবিদার। তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতেই পারে। আমি যেটা জানি না সেটা হলো, তারা একটা দল হিসেবে ভালো খেলতে পারবে কি না। আমার কাছে নেইমারই দলটির মূল খেলোয়াড়। যাই হোক, আমি এখনো মনে করি না যে, ব্রাজিল একই ছন্দে খেলে বিশ্বসেরা হওয়ার মতো প্রস্তুত আছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতেই পারে৷ পরিচিত পরিবেশের কারণেই সুযোগটা অনেক বেশি থাকছে।
সুযোগ লিওনেল মেসির সামনেও—ইতিহাসের সেরা চার ফুটবলারের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। আমি সব সময়ই বলি, ফুটবলের চার রাজা—আলেফ্রেডো ডি স্টেফানো, পেলে, ইয়োহান ক্রুইফ ও ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এখন পঞ্চম রাজা হওয়ার দাবিটা মেসি ব্রাজিলেই জানিয়ে রাখতে পারে। সিংহাসনটা অনেক দিন ধরেই খালি পড়ে আছে। ডিয়েগোর (ম্যারাডোনা) বিদায়ের পর মনে হয়েছিল মুকুটটা রোনালদোর মাথায় উঠবে, এরপর মনে হলো রোনালদিনহো, তারপর কাকা। কিন্তু কেউই পারল না।
আমি মনে করি, এই সময়ে মেসিই বিশ্বসেরা এবং সেটা অনেক বড় ব্যবধানেই। তবে বিশ্বকাপটা হচ্ছে জানালার মতো, এখানে কোনো কিছুই লুকানোর নেই। এখানে ভালো না খেললে মেসিকে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। অতীতে যে মূল্যটা দিতে হয়েছে অনেক বড় খেলোয়াড়কেই। বিশ্বকাপে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারেনি। খুব ভালো হয়, যিদ মেসি দারুণ একটা বিশ্বকাপ কাটায়। তাই বলে তাকে বিশ্বকাপ জিততেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিশ্বকাপ জেতা খুবই কঠিন কাজ। তবে বিশ্বকাপ জিতলে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের ব্যক্তিত্বটাও ফুটে উঠতে পারে। ভালো একটা বিশ্বকাপ তাকে অনেকটাই নির্ভার করবে। অবশ্য এটাই শেষ কথা নয়৷ দুই মাস পর তো তাকে বার্সেলোনায় গিয়েও খেলতে হবে এবং জিততে হবে।
বিশ্বকাপে জার্মানি যে অন্যতম ফেবারিট, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। চিরাচরিত জার্মান বৈচিত্র্য তো আছেই, এবারের জার্মানি এখন আরও অনেক কিছুই করতে পারে। তাদের খেলার ধরন খুবই আকর্ষণীয়। জার্মানিকে একমাত্র যে সমস্যাটার মুখোমুখি হতে হবে, সেটা হলো আবহাওয়া। দক্ষিণ আমেরিকানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ইউরোপিয়ানদের যে গতিতে খেলা দরকার, সেটা নিশ্চিত ব্যাহত হবে এই আবহাওয়ায়।
তবে ইংল্যান্ড ও পর্তুগালকে আমি বিশ্বকাপের দাবিদার মনে করি না। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ছাড়লেই তো ইংলিশদের পারফরম্যান্স ৪০ ভাগ পড়ে যায়! পর্তুগালেরও একই অবস্থা। পর্তুগাল হচ্ছে ‘দেখনদারি’ দল—সব সময়ই মনে হয় তারা ভালো করবে, কিন্তু বিশ্বকাপে কিছুই করতে পারে না। দুই দলেই অসাধারণ সব খেলোয়াড় আছে। আমার মনে হয়, ইউরোপিয়ানদের মধ্যে বেলজিয়ামই সবচেয়ে বড় চমক দিতে পারে।
ব্রাজিলে বিশ্বকাপ—পেলেকে স্মরণ না করে পারছি না। আমি ভাগ্যবান, তার সঙ্গে সান্তোসে খেলেছি। পেলের সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। আমি তার মতো আর কাউকে দেখিনি। এ রকম খেলোয়াড় আর আসবেও না। সে মানুষ ছিল না, ছিল অতিমানব। ছোটখাটো গড়নের হলেও সে শূন্যে প্রায় ফুট খানেক লাফিয়ে বিশ্বের সেরা হেডারের কাছ থেকেও বল কেড়ে নিতে পারত। ডান অথবা বাঁ, ফ্রিকিক নিতে পারত দু পায়েই। প্রকৃতির দান ছিল এসব। পেলে ছিল চিতার মতো ক্ষিপ্র, তার নাক ছিল রক্তখেকো প্রাণীর মতো৷ সে সবকিছুই আগে টের পেয়ে যেত। মাঝে মাঝে মনে হতো সে মাঠে নেই, কিন্তু হঠাৎই কয়েক হাত লাফিয়ে ছয় ফুট ওপর থেকে বুক দিয়ে বল নামিয়ে আনত আর নিজের কারিকুরি দেখাত।
টেকনিক্যালি পরিপূর্ণ এক খেলোয়াড় ছিল পেলে৷ বুদ্ধিমত্তাও ছিল অসাধারণ। ডিয়েগো (ম্যারাডোনা), ক্রুইফ, ডি স্টেফানো, মেসি, ক্রিস্টিয়ানো (রোনালদো), রোনালদিনহো, রিভেলিনো, বেকেনবাওয়ারদের মতো গ্রেট খেলোয়াড়রা সব সময় ছিল এবং আছে। কিন্তু পেলে? ভিনগ্রহের মানুষ!
সূত্রঃ প্রথম আলো।
Follow করুনঃ
No comments:
Post a Comment
পোস্ট সম্পর্কে মতামত দিন